TMC ও BJP-র মধ্যে SIR প্রক্রিয়াকে ঘিরে এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন স্পষ্ট করছে যে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাংলার রাজনীতি আরও উত্তপ্ত হতে চলেছে।
ত্রিণমূল কংগ্রেস (TMC)-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে। নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হতে চলা বিশেষ নিবিড় সংশোধন (Special Intensive Revision - SIR) প্রক্রিয়ার আগে তিনি দলীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন বুথ লেভেল অফিসারদের (BLOs) বাড়ি-বাড়ি ভোটার যাচাই অভিযানে সর্বদা বুথ লেভেল এজেন্টরা (BLAs) সঙ্গে থাকেন।
এই নির্দেশ শুধু প্রশাসনিক পর্যায়ে নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, TMC-এর মতে এই SIR প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজেপি (BJP) “Silent Invisible Rigging”-এর মাধ্যমে ভোটার তালিকা বিকৃত করতে চাইছে।
TMC নেতৃত্বের ভার্চুয়াল সভা: ১৭,০০০ কর্মীর সঙ্গে বার্তা বিনিময়
শুক্রবার এক ভার্চুয়াল বৈঠকে প্রায় ১৭,০০০ দলীয় কর্মী ও নেতার সঙ্গে কথা বলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় BLO-রা “এক মুহূর্তের জন্যও একা” থাকবেন না।
অভিষেক বলেন,
প্রত্যেক বুথে আমাদের কর্মীরা BLO-দের সঙ্গে থেকে নিশ্চিত করবেন যে, কোনো প্রকার অনিয়ম না ঘটে। এই SIR প্রক্রিয়া BJP-এর নির্দেশে করা হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য ভোটার তালিকাকে নিজেদের সুবিধামতো পরিবর্তন করা।
Silent Invisible Rigging: BJP-র বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, SIR মানে “Silent Invisible Rigging।” তিনি অভিযোগ করেন যে, ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে বিজেপি নীরবে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়ার চক্রান্ত করছে।
তিনি বলেন,
বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধন ঘোষণার পর আমরা বলেছিলাম, এটা নিঃশব্দে ভোটারদের সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। বাংলাতেও একই ঘটনা ঘটছে।
TMC এই ইস্যুতে সংসদ, আদালত এবং রাজপথে প্রতিবাদ চালিয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।
ভোটার তালিকা থেকে নাম গায়েব! TMC-র বিস্ফোরক দাবি
TMC মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান যে, ইতিমধ্যেই ভোটার তালিকা থেকে শত শত নাম গায়েব হয়ে গেছে।
তিনি বলেন,
২০০২ সালের ভোটার তালিকার হার্ড কপিতে যে নামগুলো আছে, সেই নামগুলো ইসি-র ওয়েবসাইটের অনলাইন সংস্করণে নেই। এটা স্পষ্ট প্রমাণ, যে নিঃশব্দে ভোটারদের বাদ দেওয়া হচ্ছে।
নাটাবাড়ির বুথ নম্বর ২-এ যেখানে হার্ড কপিতে ৭১৭ জন ভোটার ছিলেন, সেখানে অনলাইন সংস্করণে মাত্র ১৪০ জনের নাম দেখা গেছে। এমনকি, মাথাভাঙার এক বুথে প্রায় ৪০০ জন ভোটারের কোনো হদিশই নেই।
বসিরহাটে ভোটারদের নাম উধাও! আশঙ্কার ছায়া ঘনীভূত
বসিরহাটের এক বুথে ৮৫৯ থেকে ৮৯২ নম্বর পর্যন্ত ভোটারদের নাম সম্পূর্ণ ফাঁকা বলে অভিযোগ তুলেছে TMC। দলের তরফে X (পূর্বতন টুইটার)-এ লেখা হয়েছে:
২০০২ সালে এই নামগুলো তালিকায় ছিল। আজ তা গায়েব। এটা ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটারদের মুছে ফেলার অপারেশন।
এই পোস্টের মাধ্যমে দল দাবি করে, SIR আসলে “Silent Invisible Rigging”-এর ছদ্মবেশে চলছে।
BJP-র পাল্টা বক্তব্য: আদালতে যান, মিডিয়ায় নয়
বিজেপি নেতা সজল ঘোষ এই অভিযোগের জবাবে বলেন,
“এটা গুরুতর অভিযোগ। যদি প্রমাণ থাকে, TMC আদালতে যাক। মিডিয়ায় নাটক না করে আদালতের আশ্রয় নেওয়াই উচিত।”
তিনি আরও বলেন, বিজেপি ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা রক্ষার পক্ষে এবং কোনো রকম অনিয়মে তারা যুক্ত নয়।
রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকের নীরবতা
TMC-র পক্ষ থেকে এই অভিযোগগুলি প্রকাশ্যে আনার পরও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক (CEO) এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। এই নীরবতা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে জল্পনা আরও বেড়েছে।
SIR প্রক্রিয়া: রাজনৈতিকভাবে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
SIR প্রক্রিয়া সাধারণত প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়, যাতে নতুন ভোটারদের অন্তর্ভুক্তি এবং পুরনো নামগুলির যাচাই করা যায়। তবে এবারের প্রক্রিয়াটি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে হওয়ায় এর রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে।
TMC মনে করছে, এই প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে বিজেপি ভোটার তালিকাকে নিজেদের পক্ষে ঘুরিয়ে নিতে চায়। তাই দল BLO-দের কাজের প্রতিটি ধাপে তদারকি করতে চাইছে।
বুথ লেভেল এজেন্টদের (BLA) ভূমিকা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
একটি নির্বাচনে বুথ লেভেল এজেন্টদের ভূমিকা অনেকটাই অদৃশ্য হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা স্থানীয় স্তরে ভোটারদের চেনেন, কারা নতুন যোগ হচ্ছে বা কার নাম বাদ পড়ছে, তা সম্পর্কে অবগত থাকেন।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চান, এই এজেন্টরাই BLO-দের সঙ্গে থেকে বাস্তব যাচাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করুন, যাতে ভোটার তালিকায় কোনো ধরনের বিকৃতি না ঘটে।
ভোটার তালিকা বিকৃতি: গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিতে আঘাত
যদি ভোটার তালিকাই সঠিক না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের মূল কাঠামোই নষ্ট হয়ে যায়। কারণ, প্রতিটি নাগরিকের ভোটাধিকার তার সাংবিধানিক অধিকার। নাম মুছে ফেলা বা ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটার বাদ দেওয়া মানে নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া।
TMC এই বিষয়টি নিয়েই আন্দোলনকে আরও জোরদার করছে, যেন ভোটের আগে মানুষের আস্থা ফিরে আসে।
TMC-র ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ও প্রতিবাদ আন্দোলন
TMC নেতৃত্ব জানিয়েছে, তারা SIR প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রতিটি বুথে নজরদারি চালাবে। BLO-দের সঙ্গে কর্মীরা বাড়ি-বাড়ি যাবেন, এবং প্রতিটি অনিয়মের তথ্য দলীয় সদর দপ্তরে পাঠাবেন।
দল আরও ঘোষণা করেছে, যদি কোনো নাম অন্যায়ভাবে বাদ যায়, তবে তারা আইনগত পদক্ষেপও নেবে।
আরো পড়ুন: ২০২৬ নির্বাচনের আগে বড় ধাক্কা: পশ্চিমবঙ্গে ৫২৭ IAS-WBCS ট্রান্সফার
বিরোধীদের পাল্টা আক্রমণ ও রাজনৈতিক তরজা
বিজেপি ছাড়াও রাজ্যের অন্য বিরোধী দলগুলোও এই ইস্যুতে নিজেদের মতামত দিচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, TMC নিজেই আগে ভোটার তালিকা নিয়ে অনিয়ম করেছে, এখন অন্যদের দোষারোপ করছে। তবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, এবার TMC আর পিছিয়ে থাকবে না—“যেখানে অন্যায়, সেখানে প্রতিবাদ।”
ভোটারদের ভূমিকা: সচেতন থাকাই সঠিক পথ
ভোটারদেরও এখানে বড় দায়িত্ব রয়েছে। নিজের নাম ভোটার তালিকায় আছে কিনা তা যাচাই করা, ভুল থাকলে দ্রুত সংশোধনের আবেদন করা—এগুলোই এখন জরুরি।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, “প্রতিটি নাগরিকের উচিত নিজের ভোটাধিকার রক্ষার দায়িত্ব নেওয়া। সরকার নয়, জনগণই গণতন্ত্রের আসল রক্ষক।”
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ BLO-দের সঙ্গে TMC কর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার দিকে মনোনিবেশ করছে, যাতে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র রক্ষিত থাকে। আগামী কয়েক মাসে এই ইস্যু যে রাজ্যের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
