ISRO-র ঐতিহাসিক দিন: 'বাহুবলী' রকেটে সবচেয়ে ভারী যোগাযোগ স্যাটেলাইট CSM-03 আজ আকাশে! আসুন জেনে নেওয়া যাক।
ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ISRO) আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে চলেছে। দেশের মাটি থেকে উৎক্ষেপিত হয়ে যাবে সবচেয়ে ভারী যোগাযোগ স্যাটেলাইট সিএমএস-০৩ (CMS-03)। এই মিশনের নাম LVM3-M5, যা তার অসাধারণ ভারী-উত্তোলন ক্ষমতার জন্য 'বাহুবলী' নামে পরিচিত। শ্রীহরিকোটা-এর সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে বিকেল ৫টা ২৬ মিনিটে এই রকেট উড়বে আকাশের উদ্দেশ্যে। ISRO-র সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ঘোষণা করা হয়েছে, "কাউন্টডাউন শুরু! সব প্রস্তুতি সম্পূর্ণ, এবং সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টারে LVM3-M5 মিশনের জন্য কাউন্টডাউন অফিসিয়ালি শুরু হয়েছে। সব সিস্টেম গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে, লিফট-অফের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি!"
এই লঞ্চ শুধু একটি স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ নয়, বরং ভারতের মহাকাশ প্রযুক্তির এক নতুন মাইলফলক। সিএমএস-০৩ স্যাটেলাইটের ওজন প্রায় ৪,৪১০ কিলোগ্রাম, যা ভারতীয় মাটি থেকে জিইওএস (জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অর্বিট) কক্ষপথে পাঠানো সবচেয়ে ভারী যান। এটি মাল্টি-ব্যান্ড কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট হিসেবে পরিচিত, যা ভারতীয় মহাদেশসহ বিস্তীর্ণ সমুদ্র অঞ্চলে যোগাযোগ সেবা প্রদান করবে। ISRO-র মতে, এই মিশনের মূল উদ্দেশ্য হলো খরচ-কার্যকর উপায়ে এই স্যাটেলাইটকে জিটিওতে স্থাপন করা। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও অনেক গল্প—সামরিক নজরদারি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন যোগাযোগের বিপ্লব। চলুন, এই মিশনের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
LVM3-M5: 'বাহুবলী' রকেটের অসাধারণ শক্তি
LVM3-M5 (লঞ্চ ভেহিকল মার্ক-৩) ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী হেভি-লিফট লঞ্চ ভেহিকল। এটিকে ISRO বিজ্ঞানীরা জিএসএলভি (জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল) এমকে-৩ বলেও অভিহিত করেন। আজকের LVM3-M5 হলো এর পঞ্চম অপারেশনাল ফ্লাইট। এই রকেটের উচ্চতা ৪৩.৫ মিটার, এবং এটি তিন-স্তরের লঞ্চ ভেহিকল। প্রথম স্তরে দুটি সলিড মোটর স্ট্র্যাপ-অন (এস২০০) রয়েছে, যা তিরুভনন্তপুরমের বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারে তৈরি। এই দুটি বুস্টার রকেটকে লিফট-অফের সময় প্রচণ্ড থ্রাস্ট প্রদান করে।
দ্বিতীয় স্তর হলো লিকুইড প্রোপেলেন্ট কোর স্টেজ (এল১১০), যা লিকুইড প্রপালশন সিস্টেম সেন্টারে ডিজাইন করা দুটি বিকাস ইঞ্জিন দিয়ে চালিত। এবং তৃতীয় স্তর ক্রায়োজেনিক স্টেজ (সি২৫), যা রকেটের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ। এই ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনের কারণে LVM3 জিটিওতে ৪,০০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ভারী স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম। এমনকি লো আর্থ অর্বিট (LEO) এ ৮,০০০ কিলোগ্রাম পেলোড বহন করতে পারে। আগের মিশনে এই রকেট চন্দ্রযান-৩-এর সফল উৎক্ষেপণ করেছে, যা চাঁদের উতরে ভারতের ঐতিহ্য স্থাপন করেছে। আজকের লঞ্চের আগে রকেটটি সম্পূর্ণভাবে অ্যাসেম্বল করে স্যাটেলাইটের সাথে ইন্টিগ্রেট করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় লঞ্চ প্যাডে স্থানান্তরিত।
আরও পড়ুন: মহা কুম্ভ অপমান করা লালু এখন হ্যালোয়িনে? বিজেপির কড়া প্রতিক্রিয়া
এই 'বাহুবলী' নামটি এসেছে তার অসীম শক্তির থেকে। তেলুগু সিনেমা 'বাহুবলী'র মতো এই রকেটও অপ্রতিরোধ্য—এটি ভারতকে মহাকাশে স্বনির্ভর করে তুলেছে। আগে ভারতকে বিদেশী রকেটের উপর নির্ভর করতে হতো ভারী স্যাটেলাইট লঞ্চের জন্য, কিন্তু লভিএম৩ এখন সেই দিনগুলোকে অতীতের কথা করে দিয়েছে।
CMS-03: সমুদ্র-মহাকাশের যোগাযোগ সেতু
CMS-03 (কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট-০৩) একটি মাল্টি-ব্যান্ড স্যাটেলাইট, যা বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ সেবা প্রদান করবে। এর প্রধান কাজ হলো ভারতীয় মহাদেশসহ বিস্তীর্ণ সমুদ্র অঞ্চলে ডেটা ট্রান্সমিশন, টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং এবং ইন্টারনেট সার্ভিস নিশ্চিত করা। আইএসআরও-র মতে, এটি বিশেষ করে সমুদ্রপথে চলাচলকারী জাহাজ, বিমান এবং দূরবর্তী এলাকায় যোগাযোগের সুবিধা বাড়াবে। কল্পনা করুন, বঙ্গোপসাগর বা আরব সাগরের মাঝখানে একটি জাহাজে বসে আপনি হাই-স্পিড ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন—এটাই সিএমএস-০৩ (CMS-03) এর অবদান।
যদিও অফিসিয়ালভাবে ISRO এ বিষয়ে কিছু বলেনি, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে এই স্যাটেলাইটের অ্যাপ্লিকেশনে সামরিক নজরদারিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সমুদ্রসীমান্তে নজর রাখা, শত্রু নৌবাহিনীর গতিবিধি ট্র্যাক করা—এসবের জন্য এর মাল্টি-ব্যান্ড ক্যাপাবিলিটি অত্যন্ত উপযোগী। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে এটি একটি বড় লাফ। তবে, আইএসআরও-র ফোকাস সিভিলিয়ান অ্যাপ্লিকেশনে বেশি, যেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, দূরশিক্ষা এবং টেলিমেডিসিন।
ভারতের মহাকাশ যাত্রায় LVM-3 এর ভূমিকা
LVM-3 সিরিজ ভারতের মহাকাশ প্রোগ্রামের মেরুদণ্ড। এর প্রথম সফল ফ্লাইট ২০১৪ সালে হয়েছিল, এবং তারপর থেকে এটি একের পর এক রেকর্ড গড়ে যাচ্ছে। চন্দ্রযান-৩-এর মতো মিশন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট লঞ্চ—LVM-3 সবকিছুতেই সফল। এর সেলফ-রিলায়েন্স ফ্যাক্টর অসাধারণ; সব কম্পোনেন্ট দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি। এসব স্টেজের ডেভেলপমেন্টে হাজার হাজার বিজ্ঞানী কাজ করেছেন, যার ফলে ভারত এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্পেস পাওয়ারগুলোর সাথে পাল্লা দিতে পারছে।
আজকের লঞ্চের সাফল্য ভারতের অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যোগাযোগ স্যাটেলাইটগুলো ডিজিটাল ইন্ডিয়া মিশনকে শক্তিশালী করবে। দূরবর্তী গ্রামে ইন্টারনেট পৌঁছে যাবে, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ব্যবসাকে বুস্ট দেবে। এছাড়া, ISRO-র এই মিশনগুলো বিদেশী ক্লায়েন্টদের আকর্ষণ করছে। ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি থেকে নাসা—সবাই ভারতীয় রকেটের উপর ভরসা করছে।
ISRO ভবিষ্যতের দিকে আরও এক ধাপ
এই লঞ্চের পর ISRO-র পরিকল্পনায় গান্ধীযান, শুক্রযানের মতো বড় মিশন রয়েছে। LVM-3-এর আপগ্রেড ভার্সনগুলো আরও ভারী পেলোড ক্যারি করবে। কিন্তু চ্যালেঞ্জও কম নয়—ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাবে লঞ্চ উইন্ডো পরিবর্তন হতে পারে, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা তীব্র। তবু, ISRO-র ট্র্যাক রেকর্ড দেখে বলা যায়, তারা সফল হবেই।
আজ বিকেলে যখন 'বাহুবলী' আকাশ ছুঁবে, তখন পুরো দেশ গর্বিত হবে। এটি শুধু একটি লঞ্চ নয়, স্বপ্নের উড়ান। আপনারা লাইভ ট্র্যাক করুন IRSO-র ইউটিউব চ্যানেলে। ভারত মহাকাশে উড়ছে—আরও উঁচুতে!
(এই নিবন্ধটি ISRO-র অফিসিয়াল তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি।)
